২০২৪ সালে কৃষি ও পশুসম্পদে গবেষণার ক্ষেত্রে ১০টি সাফল্য অর্জন করেছে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বাকৃবি)। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই গবেষণা দিয়ে দেশের কৃষির উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন বিশ^বিদ্যালয়ের গবেষকরা। তারই ধারাবাহিকতায় এ বছরও এই সাফল্য পেল বাকৃবি। এর মধ্যে শিং মাছের জিনোম সিকোয়েন্স উদ্ভাবন থেকে শুরু করে পশুদের গর্ভপাত রোধে ব্রুসেলোসিস ভ্যাকসিনের ঊদ্ভাবন রয়েছে।
শিং মাছের জিনোম সিকোয়েন্স : বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণার মধ্যে শিং মাছের জিনোম সিকোয়েন্স উদ্ভাবন অন্যতম। গবেষণায় দেখা গেছে, স্ত্রী শিং মাছের বৃদ্ধি পুরুষ শিং মাছের তুলনায় ৪০-৬০ শতাংশ বেশি। মনোসেক্স স্ত্রী শিং মাছ উৎপাদনের লক্ষ্যে এই গবেষণা পরিচালিত হয়। এতে নেতৃত্ব দেন ফিশারিজ বায়োলজি অ্যান্ড জেনেটিক্স বিভাগের অধ্যাপক ড. তাসলিমা খানম। সহকারী গবেষক ছিলেন একই বিভাগের স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী নিত্যনন্দ, স্বর্ণা, জেসমিন, কানিজ ও সারা।
বাউ মিষ্টি আলু-৫ : কৌলিতত্ত্ব ও উদ্ভিদ প্রজনন বিভাগের অধ্যাপক ড. এবিএম আরিফ হাসান খান রবিনের উদ্ভাবিত নতুন জাত ‘বাউ মিষ্টি আলু-৫’। প্রতি গাছে ৪-৬টি কন্দ উৎপন্ন হতে পারে। প্রতিটি কন্দের গড় ওজন ২০০-৩০০ গ্রাম। এই জাত ৯০ থেকে ১০০ দিনে উৎপাদনে আসে। প্রচলিত মিষ্টি আলুর চেয়ে এর ফলন ও লাভ দ্বিগুণ। এই আলুতে নানা ভিটামিনসহ অ্যান্থোসায়ানিন ও ক্যানসার প্রতিরোধী উপাদান বিদ্যমান। এ ছাড়া গ্লাইসেমিক ইনডেক্স কম হওয়ায় এটি ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য উপকারী।
সাদা মাছির নতুন প্রজাতি শনাক্ত : সাদা মাছি আকারে ছোট। লম্বায় ১.১ থেকে ১.২ মিলিমিটার। যা নারিকেলের পরিচিত সাদা মাছির অর্ধেক হলেও প্রজনন ক্ষমতা ও জলবায়ু সহনশীলতা দ্বিগুণ। এই মাছির বৈজ্ঞানিক নাম হলো প্যারালেইরোডেস বোন্দারি, বাংলায় বলা হয় বোন্দার নেস্টিং সাদা মাছি। এই প্রজাতি শনাক্ত করেন কীটতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. গোপাল দাস এবং স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী মো. সোহেল রানা।
আমিষে ছাগলের দ্বিগুণ বৃদ্ধি : গবেষণায় ৬৩টি ব্ল্যাক বেঙ্গল মা ছাগলকে নিম্ন, মাঝারি ও উচ্চতা বিবেচনায় ৯টি দলে বিভক্ত করা হয়। তিনটি ভিন্নমাত্রার বিপাকীয় শক্তি ও তিনটি ভিন্নমাত্রার আমিষ সরবরাহ করা হয়। গবেষণায় দেখা গেছে, উচ্চমাত্রার শক্তি ও আমিষযুক্ত খাদ্য সরবরাহ করা হলে বাচ্চার জন্মের সময় ওজন, দৈহিক বৃদ্ধি হার অন্যান্য দলের চেয়ে বেশি ও মৃত্যুহার কম। অন্যদিকে নিম্নমাত্রার শক্তি ও আমিষ গ্রহণকারী দলের বাচ্চাদের পেশি তন্তুর ঘনত্ব এবং মায়োস্ট্যাটিন জিনের অভিব্যক্তি উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি দেখা গেছে। এর নেতৃত্ব দেন অ্যানিমেল সায়েন্স বিভা?গের অধ্যাপক ড. ম. মনিরুজ্জামান।
সংকর ছাগল : বোয়ার জাতের পাঁঠার সঙ্গে দেশীয় ব্ল্যাক বেঙ্গল জাতের ছাগীর সংকরায়নের মাধ্যমে একটি নতুন জাত উদ্ভাবন করা হয়। নতুন এই জাত ব্ল্যাক বেঙ্গলের সমপরিমাণ খাবারে দ্বিগুণ মাংস উৎপাদনে সক্ষম। পুরুষ ছাগল বছরে ২৬ কেজি ও মাদি ছাগল ২৩ কেজি মাংস উৎপাদন করে। এ জাতটি রোগ প্রতিরোধী ও ব্ল্যাক বেঙ্গলের মতোই সহজে পালনযোগ্য। বাকৃবির পশু প্রজনন ও কৌলিবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. রুহুল আমিন ও স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী খালিদ সাইফুল্লাহ এই জাত উদ্ভাবন করেন।
আমের মিষ্টতা জানাবে ই-নোজ : আম না খেয়েও মিষ্টতা নির্ণয় করা যাবে ইলেকট্রনিক নোজ (ই-নোজ) প্রযুক্তির সাহায্যে। এর উদ্ভাবক কৃষি শক্তি ও যন্ত্র বিভাগের অধ্যাপক ড. আনিসুর রহমান। এই যন্ত্রটিতে দুটি চেম্বার রয়েছে। একটি আর্ডিউনো ও আরেকটি রাস্পবেরি পাই ৪-এর সমন্বয়ে তৈরি। এ ছাড়া গাছ থেকে সংগ্রহের পর আম কতদিনে পেকে যাবে বা নষ্ট হবে, তাও জানা যাবে।
আমের আঁটির অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল : বিশ্বজুড়ে অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্সের কারণে প্রতিবছর লক্ষাধিক মানুষের মৃত্যু হয়। তাই প্রাকৃতিক উৎস থেকে অ্যান্টিবায়োটিকের বিকল্প বের করা জরুরি। মাইক্রোবায়োলজি অ্যান্ড হাইজিন বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. গোলজার হোসেন পরিত্যক্ত আমের আঁটির নির্যাস থেকে ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ প্রতিরোধী একটি অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল উদ্ভাবন করেছেন। এটি ব্যাকটেরিয়ার কোষ ও বায়োফিল্ম ধ্বংস করতে সক্ষম। প্রচলিত অ্যান্টিবায়োটিকের তুলনায় এটি নিরাপদ, সুবিধাজনক ও সাশ্রয়ী। গবেষণা ২০২৩ সালে শুরু হয় এবং বর্তমানে এটি পোলট্রির ক্ষেত্রে কার্যকারিতা নিয়ে উচ্চতর গবেষণা চলছে।
আলু বাছাই যন্ত্র : সঠিকভাবে আলু বাছাই করতে না পারায় অল্প সময়ে আলু পচে যায়। ফলে প্রতিবছর বিপুল অর্থ লোকসান হয়। উদ্ভাবিত এই যন্ত্রটি আকার, রঙ এবং ত্রুটি অনুযায়ী আলু প্রতি ঘণ্টায় ৩০-৩৫ কেজি বাছাই করতে পারে এবং সফলতার হার প্রায় ৮৬ শতাংশ। যন্ত্রটির নাম দেওয়া হয়েছে ‘অটোমেটেড রিয়েল-টাইম পটেটো গ্রেডিং মেশিন’। এর উদ্ভাবক কৃষি শক্তি ও যন্ত্র বিভাগের অধ্যাপক ড. আনিসুর রহমান।
অভিযোজিত ফসল উদ্ভাবনে পলি হাউস : জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে উদ্ভাবিত হয়েছে পলি হাউস। এটি একটি নিয়ন্ত্রিত পরিবেশ যেখানে তাপমাত্রা, লবণাক্ততা, আর্দ্রতা ও পানির ওপর বি?ভিন্ন ফস?লের প্রভাব বিশ্লেষণ করা হয়। অধ্যাপক ড. এবিএম আরিফ হাসান খান রবিন উদ্ভাবিত এই পলি হাউসে ৮টি সাধারণ চেম্বার, একটি কোল্ড চেম্বার এবং একটি হিট চেম্বার রয়েছে।
ব্রুসেলোসিস ভ্যাকসিন : ব্রুসেলোসিস হলো ব্রুসেলা ব্যাকটেরিয়া দ্বারা সৃষ্ট একটি রোগ, যা গবাদিপশুর ৬ মাসের পর গর্ভপাত ঘটায়। দেশের প্রায় ৫-৬ শতাংশ গবাদিপশু এ রোগে আক্রান্ত। এই রোগটি জুনোটিক বা প্রাণী থেকে মানুষে সংক্রামক হওয়ায় প্রজনন ক্ষমতা ও কর্মক্ষমতা হ্রাস, তরঙ্গায়িত জ্বর, অণ্ডকোষে প্রদাহ ও নারীর গর্ভপাতও ঘটায়। পশু চিকিৎসক ও খামারিরা এ রোগে বেশি আক্রান্ত হন। মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আরিফুল ইসলাম এই ভ্যাকসিন উদ্ভাবন করেছেন। এটি মৃত ভ্যাকসিন হওয়ায় সংক্রমণের কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই। প্রতি ছয় মাস অন্তর বুস্টার ডোজ দিতে হবে। বর্তমানে এটি গবাদিপশুর মধ্যে ব্যাপক কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে।