ডেস্ক নিউজ, এগ্রিনিউজ.লাইভ: লেখাপড়া জানা যুবক চাকরি না করে মাছ চাষ করবেন—এমনটি মানতে পারছিলেন না রহমত আলী সরকারের পরিবার ও প্রতিবেশীরা। তাঁর মাছের খামার দেখে অনেকে উপহাস ও কটুকথা বলেছেন। তবে তিনি এতে দমে যাননি; দৃঢ় মনোবল নিয়ে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেছেন। প্রথম বছরেই মাছ চাষে লাভ হয়; এতে তাঁর আত্মবিশ্বাস বাড়ে। এরপর ধাপে ধাপে বাড়তে থাকে রহমত আলী সরকারের পুকুরের সংখ্যা। বর্তমানে তিনি ৪০ হেক্টর জমিতে মাছ চাষ করছেন, এর মধ্যে আছে ২০টি পুকুর ও চারটি প্লাবন ভূমির মৎস্য চাষ প্রকল্প।
রহমত আলী সরকার কুমিল্লার দাউদকান্দি উপজেলার সিংগুলা দিঘিরপাড় গ্রামের বাসিন্দা। তাঁর এ কাজে সার্বিকভাবে সহযোগিতা করছেন স্ত্রী কুলসুম আক্তার। রহমত আলী জানান, রহমত ফিশারিজ নামের একাধিক মৎস্য প্রকল্পে পাঙাশ, শিং, কই, বাটা, রুই, তেলাপিয়া, কাতলা, মৃগেল ও কার্পজাতীয় মাছের চাষ হয়। সেখান থেকে প্রতিবছর চার কোটি টাকার বেশি মাছ বিক্রি করেন।
মৎস্য খাতে অবদান রাখায় জাতীয় মৎস্য সপ্তাহ পুরস্কার পেয়েছেন রহমত আলী। ১৮ আগস্ট রাজধানীর চীন মৈত্রী সম্মেলনকেন্দ্রে তাঁর হাতে পুরস্কার তুলে দেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। এর আগে তিনি উপজেলাপর্যায়ে একবার ও বিভাগীয় পর্যায়ে দুবার পুরস্কার পেয়েছেন।
সম্প্রতি রহমত আলীর সঙ্গে কথা হয়। মাছ চাষের গল্প জানতে চাইলে তিনি স্মৃতিচারণা করে বলেন, শুরুটা ২৫ বছর আগে। কঠোর পরিশ্রম, ধৈর্য, একাগ্রতা ও সাহসিকতার সঙ্গে এক পা-দুই পা করে আজ এখানে পৌঁছেছেন। উদ্যোক্তা হওয়ার সংকল্প ছিল ছাত্রজীবন থেকেই। ১৯৯৮ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পাসের পর টানা দুই বছর মাছ চাষের ওপর হাতেকলমে প্রশিক্ষণ নেন।
রহমত আলী সরকার জানান, মামা-বাবা-ভাই-বোন সবাই মিলে লেখাপড়া শেষ করে তাঁকে চাকরির পরামর্শ দিয়েছিলেন। কিন্তু কিছুতেই মন থেকে সায় পাচ্ছিলেন না। ২০০০ সালের দিকে দাউদকান্দি উপজেলার রায়পুর সেতু কাছে ৩০ শতক ডোবা ইজারা নিয়ে মাত্র পাঁচ হাজার টাকা পুঁজিতে শুরু করেন মাছ চাষ। তখন বাণিজ্যিকভাবে তেমন মাছ চাষ হতো না। সব প্রতিকূলতার মধ্যে তিনি প্রথম বছরই লাভবান হন। খরচ বাদ দিয়ে দ্বিতীয় বছর পুঁজি হয় ১০ হাজার টাকা। এভাবে বাড়তে থাকে পুকুর ও মাছের সংখ্যা।
মাছ চাষ নিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার বিষয়ে জানতে চাইলে রহমত আলী সরকার বলেন, আশপাশের পরিত্যক্ত জায়গাগুলো কাজে লাগিয়ে মৎস্য প্রকল্পের সংখ্যা আরও বাড়ানোর ইচ্ছা রয়েছে। কম জায়গায় কীভাবে বেশি মাছ চাষ করা যায়—এমন বিষয়ের ওপর তিনি প্রশিক্ষণ নিয়েছেন।
তরুণদের চাকরির পেছনে না ছুটে উদ্যোক্তা হওয়ার পরামর্শ দেন রহমত আলী। তিনি বলেন, এতে স্বাবলম্বী হওয়ার পাশাপাশি বেকারদেরও কর্মসংস্থান করা যায়। পাশাপাশি দেশের অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখা যায়।। তাঁর মৎস্য চাষ প্রকল্পগুলোতে ৬০ জন শ্রমিক নিয়মিত কাজ করেন। এর মাধ্যমে তিনি ৬০টি পরিবারের দায়িত্ব নিতে পেরেছেন। মাছ চাষের আয়ের টাকায় পরিবারের সদস্যদের নিয়ে খেয়েপরে বেশ ভালোই আছেন। বসতবাড়িতে নজরকাড়া ভবন নির্মাণ করেছেন। কিছু জমি কিনেছেন। সেই সঙ্গে ছেলেমেয়েদের লেখাপড়াও করাচ্ছেন। গরিব-দুঃখী মানুষকে নিয়মিত সাহায্য-সহযোগিতা করছেন। মেধাবী শিক্ষার্থীদের জন্য ব্যবস্থা করেছেন বৃত্তির। তাঁর উৎপাদিত রেণুপোনার মধ্যে জনস্বার্থে কিছু রেণুপোনা উন্মুক্ত জলাশয়ে ছেড়ে দিচ্ছেন।
সমাজসেবায় রহমত আলীর ভূমিকা তুলে ধরে স্থানীয় রায়পুর কে সি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আবদুল মোমেন ভূঁইয়া বলেন, ‘তিনি প্রতিবছর কিছু টাকা গরিব মেধাবী শিক্ষার্থীর বিলিয়ে দেন। সমাজের প্রতিটি মানুষ এভাবে এগিয়ে এলে মেধাবী শিক্ষার্থীর সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাবে, তাঁদের ঝরে পড়ার হার কমবে।’
রহমত আলী এখন অনেকের জন্যই অনুকরণীয়। নতুন উদ্যোক্তারা নিয়মিতভাবে তাঁর পরামর্শ নিতে রহমত ফিশারিজ পরিদর্শনে যান। তাঁদেরই একজন ফারুক আহমেদ নামের এক তরুণ। রহমতের পরামর্শে তিনি গড়ে তুলেছেন নিজের একটি মৎস্য খামার। ফারুক আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, রহমত আলীকে দেখেই তাঁর মতো অনেক তরুণ উদ্যোগী হয়েছেন।
উপজেলা জ্যেষ্ঠ মৎস্য কর্মকর্তা সাবিনা ইয়াছমিন চৌধুরী বলেন, মৎস্য খামার বেকারদের স্বাবলম্বী হওয়ার জন্য অন্যতম উদাহরণ রহমত ফিশারিজ। চাকরির পেছনে না ছুটে তরুণদের রহমত আলীর মতো এগিয়ে আসা উচিত। মাছ চাষে সফল রহমত আলী পেয়েছেন জাতীয় পুরস্কার শিরোনামে সংবাদটি প্রথম আলো থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে।